খুব শীতে, নিঝুম দ্বীপে (পর্ব – ২)
আজ
একটু আয়েশ করে সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘুমালাম। শীতের সকালের ঘুমের থেকে আরামদায়ক আর
কিছু হতে পারে না। এরপর নাস্তা করে আমরা ট্রলারে করে মনপুরা দ্বীপে রওনা দিলাম।
নিঝুম দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত মনপুরা দ্বীপ। এটি বেশ বড় একটি দ্বীপ। মনপুরা
দ্বীপে পৌছাতে দুপুর ২.৩০ বেজে গেলো। সেখানে গিয়ে আমরা একটি ছোট দোকানে খাওয়াদাওয়া
করলাম। তিনজন বাইক ভাড়া করে নিয়ে পুরো দ্বীপ ঘুরতে বের হলো। আমরা কয়েকজন মনপুরা
দ্বীপের বীচের খোজে গেলাম।
মনপুরা
দ্বীপের বীচটি সবেচেয়ে সুন্দর লেগেছে। এখানের বালুগুলো নিঝুম দ্বীপের মত এতটা কাঁদাকাঁদা
নয়। বীচের পুরোটা ঘুরে দেখতে ও ছবি তুলতে তুলতে বিকাল হয়ে গেলো। আমরা আবার রওনা
দিলাম নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে। মাঝে আরো কিছু চর পড়লো তবে আর আমরা অন্য কোন চরে
নামিনি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায়। সূর্যাস্ত দেখলাম ট্রলারে বসে থেকে।
মনপুরা দ্বীপ। ছবিঃ তাসনিম। |
নিঝুম
দ্বীপের নামারবাজার ঘাটে নেমে কিছুক্ষন মার্বেল খেললাম স্থানীয় পিচ্চিদের সাথে।
পেটে প্রচুর ক্ষিধা লেগেছে। তাই খেতে আমরা গেলাম বাজারে। লুচি, মিষ্টি ও সবজি
খাওয়া হলো পেটপুরে। এরপর আমরা রিসোর্টে চলে গেলাম। আজ রাতে ক্যাম্পিং করবো। তাই
সেটার গোছগাছ করতে হবে।
রিসোর্টটি
আজ সুন্দর করে লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে ডিসি আসবে বলে। কাল শুক্রবার। তাই আজ রাতে
ডিসি আসবেন তার পরিবার নিয়ে। সারা রাত গানবাজনার আয়োজন করা হয়েছে। রাতে রিসোর্টের
মিলন ভাই আমাদের রুমে গান শোনাতে আসলেন। তার গানের গলা খুবই সুন্দর। তবে তার
প্রতিটি গানই দারুন কষ্টের। গান শুনেই কষ্ট লাগা শুরু করে বুকের ভেতর। তাকে বেশ
কয়েকবার খুশির গান গাইতে বলা হলেও সে শেষমেষ দূঃখের গানই গাইলেন।
ক্যাম্প
করার জন্য আমরা রাত ১০টার দিকে রওনা দেই হোটেল থেকে। প্রথমে বীচেই ক্যাম্পিং করার
কথা ছিলো। কিন্তু বাইরে আজ প্রচন্ড বাতাস আর হাড় কনকনে শীত। আর বেশীরভাগেরই এটাই
প্রথম ক্যাম্পিং। তাই ঠিক হলো রিসোর্টের পিছনে কিছুদুর গিয়ে ক্যাম্পিং করার জন্য।
ঘন জঙ্গলের পাশে একটু খোলা জায়গা দেখে সেখানে তাবু বিছানো শুরু হলো। আমরা বনের
ভেতর গেলাম আগুন জ্বালানোর জন্য লাকড়ি জোগাড় করতে। কিন্তু ভালো লাকড়ি পাওয়া
গেলোনা। সবই কুয়াশায় ভিজে গিয়েছে। পরে একটি বাড়ি থেকে কাঠ কিনে আগুন জ্বালানোর
ব্যবস্থা করা হলো।
--
ক্যাম্পফায়ার। ছবিঃ রিশাদ। |
ক্যাম্পিং হচ্ছে। ছবি তুলেছে আজিজ ভাই। |
রাতে
লাকড়ির আগুনে খেজুর রস আর চাল দিয়ে সিন্নি রান্না করা শুরু হলো। আগুনের পাশে গোল
হয়ে আমরা আড্ডা দিতে থাকলাম। বাইরে প্রচুর শীত। আবার আগুনের কাছে গেলেও সমস্যা।
ধোয়ায় চোখ জ্বালাপোড়া করে। গাছের সাথে হ্যামক টাঙ্গানো হলো। রাত ৪টার দিকে সিন্নি
বানানো শেষ হলো। আমরা সিন্নি খেলাম। এরপর অনেকেই তাবুতে শুয়ে পড়লো। আমি আরো
কিছুক্ষন আগুনের সামনে বসে ভোরের দিকে তাবুতে ঢুকলাম। তাবুর ভেতর আরো ঠান্ডা। শুয়ে
পড়তেই যেন মনে হলো নিচে যেন মাটি নয় বরফ দেওয়া আছে। তবে অনেক ভারী জ্যাকেট আর মোজা
পড়েছিলাম বলে রক্ষা। কিভাবে যেন ঘুমিয়ে গেলাম টেরও পেলাম না। এটা আমার প্রথম
ক্যাম্পিং, তাবুতে প্রথম ঘুমালাম।
৪র্থ
দিন (৫ জানুয়ারী ২০১৮)
ঘুম
থেকে উঠে আবিষ্কার করলাম আমি টেন্টের ভেতরে আর বাইরে প্রচুর রোদ। ঘড়িতে দেখলাম
১১টা বাজে। এতক্ষন ঘুমিয়েছে মনেই হচ্ছে না। বাইরে বের হয়ে দেখি অনেকেই ঘুম থেকে
উঠে চলে গেছে। আমি টেন্টটি খুলে ভাজ করতে শুরু করলাম। টেন্ট লাগানোর থেকে খুলে ভাজ
করে প্যাকেটে ঠিকমত ভরা আরও বেশি কঠিন কাজ। এরপর সবকিছু নিয়ে হোটেল রুমে চলে
গেলাম। কেউ এখনো নাস্তা করে নি। আমরা আজই নিঝুম দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবো। আমাদের চর
কুকরি-মুকরি যাবার কথা ছিলো। কিন্তু সেখানে একটিমাত্র রিসোর্ট রয়েছে কুকরি-মুকরি
হাই-ফাই রিসোর্ট নামের। সেই রিসোর্টটি আজ থেকে বুক করা ভিআইপি আসবে বলে। ওখানে
ক্যাম্পিং করার আইডিয়াও বাদ দিতে হলো কেননা চর কুকরি-মুকরিতে খুবই কম মানুষ বাস
করে আর ক্যাম্পিং করার জন্য ততটা নিরাপদ নয়। আর কাল রাতে ক্যাম্পিং করে আমরা সবাই
টের পেয়েছি যে শীতের রাতে ক্যাম্পিং খুব মজাদার হলেও মোটেও আরামদায়ক নয়।
ক্যাম্পিংয়ের পরের সকাল। ছবিঃ সজীব। |
বাজার
থেকে খাবার কিনে জলদি উঠে পড়লাম ট্রলারে। আমরা এবার যাবো নোয়াখালীর চেয়ারম্যান
ঘাটে। সেখান থেকে যাবো নোয়াখালীর চাটখিল শহরে। আমাদের সাথে থাকা আজিজ ভাইয়ের বাসা
সেখানে। সেখানে একদিন থেকে নোয়াখালী ঘুরে বেড়াবো।
এই ট্রলারে করেই ঘুরাঘুরি করেছি। ছবিঃ তাসনিম। |
ট্রলার
যাত্রা শুরু করলো। এবার প্রায় ৫ ঘন্টা লাগবে আমাদের নোয়াখালীর চেয়ারম্যান ঘাটে
পৌছাতে। ট্রলারে ওয়ান টাইম প্লেটে সবাইকে খাবার দেওয়া শুরু হলো। নিঝুম দ্বীপ ছেড়ে
যেতে খুব খারাপ লাগছিলো। নিঝুম দ্বীপ থেকে ট্রলারে উঠার সময় লিটন পিচ্চি আমাদের
ট্রলারে উঠে যায়। ট্রলার ছেড়ে দিলে মাঝি তাকে পানিতে ফেলে দেয়। সে সাতরিয়ে পাড়ে
উঠে। এটা দেখে খুব খারাপ লেগেছিলো। আরমান আর লিটন – এই দুইজন পিচ্চি পুরো সময়
আমাদের সাথে থেকেছে, মনে হয়েছিলো আমারই আপন ছোটভাই। নিঝুম দ্বীপের মানুষ আমার কাছে
ভালোই লেগেছে। তবে তারা একটু অন্যরকম। এ দ্বীপের মানুষ খুব কম কথা বলে। যা জিজ্ঞেস
করি তাই উত্তর দেয় শুধু। নিজ থেকে কোন বিষয়ে তারা আগ্রহ দেখায় না। কেমন যেন মনমরা
এলাকার মানুষগুলো। চর অঞ্চলের মানুষ মনে হয় এমনই হয়। নদীর ভাঙ্গনে তাদের বাড়িঘর
প্রতিবছর ভেঙ্গে যায়। এজন্য জগতের সব কিছুতেই হয়তোবা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে তারা। আরেকটি
ব্যাপার হলো আমরা এই কদিন দ্বীপ একজন মহিলাও দেখিনি। জানা গেল এখানে সবাই অনেক
ধার্মিক। মেয়েরা ঘরের বাইরে বের হয়না, অনেক পর্দা করে চলে।
সূর্যমামা ঘুমাতে যাচ্ছে। ছবিঃ সজীব। |
দুপুর
গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে যাচ্ছে। ট্রলার এখনও চলছে। অলস সময় কাটছে পানিতে। কিছুক্ষন
গানের কলি খেললাম, আড্ডা দিলাম। নিঝুম
দ্বীপ, কবিরাজের চর, মনপুরা দ্বীপ, হাতিয়া সব ছেড়ে ট্রলার যেয়ে উঠলো মেঘনা নদীতে। এই
মেঘনা নদী পার হয়ে অন্য পাশে গেলেই চেয়ারম্যান ঘাট। বিশাল নদী এই মেঘনা। চারদিকে
তাকালে মনে হয় সাগরে আছি। কোথাও ডাঙ্গার কোন চিহ্ন নেই। বড় বড় ঢেউ এসে বাড়ি দিতে
লাগলো আমাদের ট্রলারে। সবাই একটু ভয় পেয়ে গেলাম। যত সময় যাচ্ছে ট্রলার আরো জোরে
দোলা শুরু করছে। আরো বড় বড় ঢেউ আসছে। একসময় মাঝ নদীতে আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ
হয়ে গেলো। মাঝিরা ইঞ্জিন মেরামত করতে নিচের ঘরে গেলো। বুঝলাম তেলের ট্যাংক থেকে তেল লিক
করেছে। এরপর ঢেউ এর ধাক্কায় আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। জলদি লাইফজ্যাকেট পড়ে ফেলি।
অন্যরাও লাইফজ্যাকেট পড়ে। তবে ভাগ্য ভালো একটু পর ইঞ্জিন চালু হয় আর ট্রলার চলতে
শুরু করে। আরো মিনিট দশেক এরকম বড় বড় ঢেউ পাড়ি দিয়ে আমরা ডাঙ্গা দেখতে পাই সামনে।
সন্ধ্যার
আগেই পৌছে যাই নোয়াখালীর চেয়ারম্যান ঘাটে। সেখানে নেমেই হোটেলে খাবার খাই। আজ
অনেকদিন পর মুরগীর মাংসের রান্না পেলাম। ভাত, মুরগীর মাংস, ডাল খেয়ে তারপর মিষ্টি
ও চা খেয়ে উঠে পড়ি। আরও অনেক পথ যেতে হবে। ঠিক করা হলো ৩টি সিএনজি। এতে করে আমরা
নোয়াখালীর চাটখিলে পৌছাবো। শুনলাম রাস্তা নাকি ভালো নয়।
সিএনজিতে
করে আধা ঘন্টা যাবার পর আমরা পথে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের
সামনে থামি। তখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুক্ষন ঘুরে ছবি তুলে আবার
যাত্রা শুরু হয় আমাদের। আরো এক ঘন্টা পর পৌছে যাই নোয়াখালীর চাটখিলে। সেখানের একটি
রেস্টুরেন্টে যাই চা খেতে। ঢুকে দেখি সেটি একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। নাম গ্র্যান্ড
রেস্টুরেন্ট। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে শুধু চা খেতে এসেছি শুনে খুবই বিরক্ত হলো ওয়েটার
বোঝা গেলো।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ছবিঃ সজীব। |
চা
খেয়ে আমরা যাই আজিজ সুপার মার্কেটে। এটি আজিজ ভাইয়ের মার্কেট। বিশাল বড় একটি
মার্কেট। ৪ তলা পর্যন্ত দোকান। এরপর থেকে ফ্ল্যাট বাসা শুরু। আমরা ৬ তলায় আজিজ
ভাইয়ের ফ্ল্যাটে উঠি। রাতে পোলাও মাংস দিয়ে এক জম্পেস ডিনার হয়ে যায়। তারপর
কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। কাল নোয়াখালীর আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো
ঘুরে দেখবো।
পর্ব - ৩ পড়ুন এখানে
পর্ব - ৩ পড়ুন এখানে
0 comments:
Post a Comment