পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে, স্বর্গের খোঁজ (পার্ট – ৩)
নাফাখুমের
পথে (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
থুইসাপাড়া
থেকে নাফাখুমের পথে যাত্রা শুরু করলাম সকাল ৭টায়। সিমিয়ান দাদা বললেন এ পথে আর
তেমন কোন পাহাড় নেই। শুধু ঝিরিপথ আর খাল। আমি খাল নিয়ে ভয়ে আছি। কেননা কাল দুপুরে
অনেক বৃষ্টি হয়েছে। খালের পানি বেড়ে গেলে পার হতে সমস্যা। তবে ভরসার কথা হলো
আমাদের সাথে রশি, লাইফজ্যাকেট ও আরো দুইজন গাইড রয়েছে।
আবার
শুরু হলো পাহাড়ে ট্রেকিং। রাস্তা মোটামুটি ভালোই। খাড়া পাহাড়ে উঠা বা নামার ঝামেলা
নেই। একটু পরপর পানি ও পাথর আসছে। আমরা প্রায় দুই ঘন্টা হাটলাম। এর মাঝে আরো দুইটি
ছোট খাল পার হলাম হেটে হেটেই। খালে কোমড় পানি ছিলো। স্রোত খুব কম ছিলো। সমস্যা
দেখা দিলো বড় একটি খালে এসে। এখানে পানির গভীরতা প্রায় মাথার সমান। আর খালটাও বেশ
বড়। খালের এ মাথা থেকে অন্য মাথায় রশি বাধা হলো। আমরা সবাই লাইফজ্যাকেট পড়ে নিলাম।
এই প্রথম লাইফজ্যাকেটগুলো কোন কাজে এলো। আমি পানি দেখে বেশ ভয়ে ছিলাম। অবশ্য পানির
স্রোত এখানে কমই আছে। তবুও আমি সাতার জানিনা দেখে বেশ ভয়ে ছিলাম।
ট্রেকিং চলছে |
সদসদসদস
খাল পারাপার |
সিমিয়ান
দাদার সাথে রশি ধরে খাল পার হলাম। এ পাড়ে এসে বুঝলাম এটা আসলে ভয়ের কোন ব্যাপারই
না। লাইফজ্যাকেট সবসময় ভাসিয়ে রাখে। আর দড়ি ধরে সামনে আগালেই এ পাড়ে চলে আসা যায়।
মজার ব্যাপার হলো নতুন দুইজন গাইডের একজন সাতার জানে না। তাই তাকে লাইফজ্যাকেট
পড়িয়ে পার করা হলো। আরো আধা ঘন্টা হাটার পরই এসে পড়লাম নাফাখুম জলপ্রপাতে। এই আধা
ঘন্টা আমার খুব কষ্ট হয়েছে। আমি কাদায় পা দিয়েছিলাম। কোমড় সমান কাদায় ডুবে
গিয়েছিলাম। কাদা থেকে উঠে হাটতে কষ্ট হচ্ছিলো। বার বার পিছলে যাচ্ছিলাম। আমার
জুতার বেল্টও খুলে গেলো। নাফাখুমে এসে ভালোভাবে শরীর ধুয়ে ফেললাম। দাদা আমার জুতার
বেল্ট লাগিয়ে ঠিক করে দিলো। এখানে কিছুক্ষন বসে ছবি তুললাম সবাই। বিকট শব্দে জল
পড়ছে উপর থেকে। বর্ষাকাল দেখে পানিও অনেক। দেখেই সব কষ্টের কথা ভুলে গেলাম আমরা।
দাদা কোথা থেকে বিশাল একটা পাহাড়ি শশা এনে কেটে সবাইকে দিলো। আমরা পানিতে বসে বসে
শশা খেলাম। এখানে পানির মাঝে কিছু গর্ত আছে। সেখানে শরীর ডুবিয়ে আরামে বসে থাকা
যায়। একে প্রাকৃতিক জ্যাকুজ্জি বলা যেতে পারে।
নাফাখুম জলপ্রপাত |
সিমিয়ান দাদার সাথে |
প্রচুর চিল হচ্ছে |
প্রায়
এক ঘন্টা নাফাখুমে কাটিয়ে আমরা আবার হাটা শুরু করলাম। কিছু দূরে বোট আছে। আরো কিছু
জঙ্গলে পথ আর পাথর পাড়ি দিলাম হেটে। বোটের কাছে পৌছালাম দুপুর ৩টার দিকে। আমাদের
ট্রেকিং এখানেই শেষ। এরপর আর কোন হাটাহাটি নেই। এক বোট থেকে আরেক বোটে যেতে আমি পা
দিলাম নিচে। ভেবেছিলাম পানি কম আছে। কিন্তু গেলাম একদম বুক সমান পানিতে ডুবে। বোট
ধরেই ছিলাম। সেটা ধরেই উঠে গেলাম। আমার ব্যাগ পুরোপুরি ভিজে গেলো। এতবার খাল পার
হলাম ব্যাগ ভিজলো না। আর এখানে এসে পুরা ব্যাগটাই ভিজে গেলো।
ভয়ংকর সুন্দর সাঙ্গু নদী |
ইঞ্জিনের
গর্জন করে বোট যাত্রা শুরু করলো। বেশ রোদ উঠেছে। আমরা এখন রেমাক্রি যাচ্ছি। মাত্র
২০-২৫ মিনিটেই আমরা এসে পড়লাম রেমাক্রি ফলসে। অসাধারাণ সুন্দর একটি জায়গা। বোট
আমাদের পাড়ে নামিয়ে দিয়ে সামনে চলে গেলো। আমরা রেমাক্রী ফলসে বসে বিশ্রাম করতে
থাকলাম আর ছবি তুললাম। ঠিক হলো আমরা আজ রেমাক্রিতেই থেকে যাবো। রেমাক্রী ফলসে বসে
বসে সূর্যাস্ত দেখলাম।
বোটে
করে আবার রেমাক্রি ফলসের অন্য পাশে নামিয়ে দিলো। আমরা যে কটেজে উঠলাম তার নাম
“নাফা খুম হোটেল”। এখানে দুই তলার শেষের দুইটা রুম আমাদের। ভাড়া প্রতিজন ১৫০ টাকা
করে আর খাবারও প্রতি বেলা ১৫০ টাকা করে পার পার্সন। রুমের বারান্দা থেকে রেমাক্রি
ফলস দেখা যায়। মনে হলো কত বছর পর সভ্য জগতে ফিরে এলাম। এখানে পাকা বাথরুম আছে।
গোসল করার জন্য পানি আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো রুমে ফ্যান আছে এবং সেই ফ্যান ঘুরে।
সবাই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আরেকটু পর একবারে রাতের খাবার
খেয়ে নিবো।
রেমাক্রি ফলস |
খাবার
খাওয়ার জন্য একটু উপরের হোটেলে গেলাম। একটি ঘরের সামনে চায়ের দোকান। তার ভেতরে বসে
খাওয়ার ব্যবস্থা। যারা সেখানে কাজ করে ঐ ঘরেই তারা রাতে থাকে। অনেকদিন পর আমরা
সাদা চালের ভাত পেলাম। সাথে ছিলো মুরগীর মাংস, সবজি, ডাল ও আলু ভর্তা। খেতে অমৃত
মনে হচ্ছিলো। এবার খাবার সময় আমাদের কারো মুখের উপরের তালুতে ব্যথা হলোনা। বুঝলাম
এটা পাহাড়ি লাল চালের ভাতের জন্য অথবা ঝর্ণার পানির জন্য হয়েছিলো।
গান
গেয়ে আড্ডা দিয়ে একদম অলস মোডে রাতের বাকি সময় পার করলাম আমরা। রেমাক্রী বাজার
ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ছোট্ট একটি বাজার। রাত ১০টায় সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। আমি কোন ছবি
তুলতে পারলাম না। আমার ফোনে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে। দিদির দোকানে ফোন দিয়ে এলাম।
তারা চালের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবে।
বারান্দায়
বসে আড্ডা দিচ্ছি আর শুরু হলো বৃষ্টি। সবাই খুব টায়ার্ড ছিলো। একটু পরেই ঘুমিয়ে
গেলাম। কাল বোটে করে থানচি চলে যাবো। সেখান থেকে ঢাকার বাসে। যদি সময় থাকে তাহলে
বান্দরবান শহরের আশেপাশে ঘুরে দেখবো।
এই ট্যুর নিয়ে লেখা অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলোঃ
এই ট্যুর নিয়ে লেখা অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলোঃ
0 comments:
Post a Comment