পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে, স্বর্গের খোঁজ (পার্ট – ১)
প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন উপাদানগুলো ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে
আকর্ষণ করে। কেউ সমুদ্র ভালোবাসে, কেউ দ্বীপ, কেউবা আবার প্রাচীন স্থাপত্য দেখতে
ছুটে যায় বহুদূরে। আমাকে পাহাড় আকর্ষণ করে সবচেয়ে বেশি। আর পাহাড় অনুভব করতে চাইলে
বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার কোন জুড়ি নেই।
এর আগেও বান্দরবানে আমি পাঁচবার যাই। কিন্তু এখনো দেখার অনেককিছুই বাকি রয়েছে। আরো ৬-৭ বার গেলেও মনে হয় পুরোটা শেষ করা যাবে না ঘুরে। ভার্সিটি জীবন শুরু করার পর আগের বন্ধুগুলোর সাথে আর সময় মিলাতে পারিনা ট্যুর দেওয়ার জন্য। এজন্য অনেক ট্যুরের প্ল্যান করার পরেও তা ক্যান্সেল হয়ে যায়। এরকম সমস্যায় আরো অনেকেই পড়ে। তাই আমি ও আমার দুই বন্ধু জুবায়ের ও সজীব মিলে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলি NSU Adventure Club নামে। এটি একটি আন-অফিসিয়াল ক্লাব যেখান থেকে প্রতি সেমিস্টার ব্রেকে ট্যুর আয়োজন করা হয়। এছাড়াও North South University তে পড়েন এমন কেউ ট্যুর অর্গানাইজ করতে চাইলে এখান থেকে আগ্রহী মানুষ পেতে পারে। ভ্রমনপিপাসুদের জন্য এটি একটি হাব হিসেবে কাজ করে। এটি ছিলো আমাদের ৪র্থ ট্যুর। এর আগে চট্টগ্রামের ঝর্নাগুলো নিয়ে একটি ট্যুর, কুতুবদিয়া-মহেশখালী-কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন ট্যুর ও সিলেট ট্যুর আয়োজন করা হয়। তবে আমি এর আগে শুধু সেন্ট মার্টিন ট্যুরে গিয়েছিলাম।
এটি একটি ট্রেকিং ট্যুর ছিলো। আমাদের প্ল্যান ছিলো
বান্দরবানের থানচি উপজেলায় অবস্থিত নাফাখুম জলপ্রপাত, আমিয়াখুম, সাতভাইখুম,
রামাপফখুম ঘুরে দেখার। আমাদের এই ট্যুরের মোট সদস্য সংখ্যা হলো ১২ জন। সাধারণত
সবাই থানচি থেকে রেমাক্রি হয়ে নাফাখুম যায়। এটাই সহজ রুট। কিন্তু আমরা ট্রেকিং
করার জন্য এবং আদিবাসী পাড়ায় থাকার জন্য অন্য একটি রুট ব্যবহার করি। আমরা ঠিক করি
থানচি থেকে পন্বঝিরি হয়ে থুইসাপাড়ায় যেয়ে থাকবো। সেখান থেকে আমিয়াখুম, সাতভাইখুম, ভেলাখুম
ঘুরে আসবো একদিন। তার পরেরদিন নাফাখুম ঘুরে রেমাক্রি চলে যাবো। ট্যুরের প্রথম
থেকেই সবাইকে সতর্ক করা হয়েছিলো প্রচুর হাটতে হবে এবং কষ্ট হবে এই কথা বলে।
ট্রেকিং এর সকল সরঞ্জাম ও সেফটি ছিলো আমাদের।
ট্যুরের প্রস্তুতি নিচ্ছি |
ঢাকা থেকে যাত্রা (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
বান্দরবান যাবার জন্য ইউনিকের নন-এসি বাস ঠিক করা হলো। ভাড়া
জনপ্রতি ৬২০ টাকা করে। আমার বাসা কলাবাগান থেকে কাছে হওয়ায় আমি সেখান থেকে ইউনিকের
মিনিবাসে উঠলাম রাত ৯ টায়। আমার
সাথে আরো তিনজন সেখান থেকে উঠলো – সাজ্জাদ ভাই, আফিয়াত ও তাসনীম। এরপর বাস
টিটিপাড়ার মেইন কাউন্টারে নামিয়ে দিলো। সেখানে বাকি সবাই অপেক্ষা করছিলো। সেখানে
গিয়ে আমি দেখা পেলাম জুবায়ের, তাসদিদ, সাহিদ, সুস্মিতা, সালমান, সোয়েব ভাই,
আন্তিক, নাঈম ভাইয়ের। রাত ১১টায় মেইন বাস এলে আমরা সবাই রওনা হলাম বান্দরবানের
উদ্দ্যেশ্যে।
ব্রেকের সময় এভাবে বাসের ছবি তুলেছিলাম যাতে ভুল বাসে না উঠে পড়ি |
বান্দরবানে পৌছানো (১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
বাস বান্দরবান শহরে সকাল ৭টায় পৌছালো। এর মাঝে রাতে
কুমিল্লার হাইওয়ে-ইনে ব্রেক দিয়েছিলো। আমরা সেখানে হালকা নাস্তা করেছিলাম।
বান্দরবান শহরে নেমে একদল গেলো চান্দের গাড়ি ঠিক করতে। আরেকদল হোটেল থেকে কলা আর
পাউরুটি কিনে নিলো সকালের নাস্তার জন্য। কোথাও বসে নাস্তা করার সময় নেই কেননা খুব
দ্রুত থানচি যেতে হবে আমাদের।
আগে বান্দরবানে চাঁন্দের গাড়িগুলোর ভাড়া চালকের সাথে কথা
বলেই ঠিক করা হত। কিন্তু এবার যেয়ে বুঝলাম তারা সিন্ডিকেট করেছে। অফিসে কথা বলে
সিরিয়ালের গাড়ি নিতে হবে। অফিসে গিয়ে জানলাম ভাড়া ৬০০০ টাকা। কিন্তু আগে ভাড়া আরো
কম ছিলো। যাইহোক, ৫৫০০ টাকায় চাঁন্দের গাড়ি ঠিক করা হলো থানচি পর্যন্ত। চান্দের
গাড়ির ড্রাইভার ওয়াজিদ (ফোন নাম্বার- ০১৮২০৪৩১১৭২)
শুরু হলো চাঁন্দের গাড়ির যাত্রা। খোলা ছাদ, চারদিকে বাতাস।
সবাই খুব ফুরফুরে মেজাজে মজা করতে থাকলাম আর মেঘ দেখতে থাকলাম। বর্ষাকালে
বান্দরবানে যাওয়ার মজা হলো এসময় আপনি প্রচুর মেঘ পাবেন আর সব মেঘ থাকবে হাতের
কাছেই। পথে দুইটি বিজিবির চেকপোস্টে আমাদের নাম এন্ট্রি করতে হলো। একটি চেকপোস্টে
গাড়িতে থাকা সবার ব্যাগ চেক করা হলো। আমরা ঐ চেকপোস্টে বসে নাস্তা সেড়ে নিলাম আর
চা খেলাম।
চলছে চান্দের গাড়ি |
চাঁন্দের গাড়ি করে থানচি পৌছাতে আমাদের ১১.৩০ বেজে গেলো।
আগে থেকেই গাইড ঠিক করা ছিলো- সিমিয়ান ত্রিপুরা তার নাম (ফোন নাম্বার –
০১৮৬৯০০১৭১০)। সিমিয়ান দাদা আমাদের
নিয়ে গেলেন গাইডদের অফিসে। সেখানে আমরা ফ্রেশ হলাম, অরেঞ্জ আর লেমন জ্যুস খেলাম।
দুইটি ফর্মে আমাদের সবার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, প্যারেন্টসের ফোন নাম্বার
লিখতে হলো। ফর্মের জন্য ৫০ টাকা নেওয়া হয়েছিলো। আমাদের জন্য ৩টি বোট ঠিক করা হলো
পন্বমুখ পর্যন্ত। সেখান থেকে আমরা ট্রেকিং করে বাকি রাস্তা যাবো। থানচির পুলিশ
অফিসার আমাদের গ্রুপের একটি ছবি তুললেন। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটি একটি রিমোট
এরিয়া। তাই সব ধরনের সতর্কতা নিচ্ছে পুলিশেরা। এসব কাজ করতে করতেই অনেক সময় নষ্ট
হলো। আমাদের আরো আগে বোটে উঠার কথা ছিলো।
আমাদের টিম |
দুপুর ১.৩০টায় কটকটে রোদের মাঝে আমরা বোটে চড়লাম। প্রতি
বোটে ৪ জন করে। আর প্রতি বোটের সাথে দুইজন করে মাঝি রয়েছে। ইঞ্জিনচালিত বোট তিনটি
গর্জন করতে করতে সাঙ্গু নদী ধরে ছুটে চলল। যেতে যেতে আবার গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হলো।
আকাশে সুন্দর রংধনু দেখতে পেলাম। দুইপাশে পাহাড় আর মাঝ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। নদীপথ
আস্তে আস্তে ছোট হতে শুরু করলো। আর তার উপরে থাকা পাথরগুলোর আকারও বাড়তে লাগলো।
পাহাড়ের ভাঁজে |
আমরা পন্বঝিরিতে পৌছালাম ৩.৩০টায়। সেখানে পাহাড়ের সাথে ঘেষে
একটা জায়গায় আমাদের বোট থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের ১২ জনের সাথে থাকলো গাইড
সিমিয়ান দাদা। এখান থেকেই শুরু হবে থুইসাপাড়া পর্যন্ত ট্রেকিং। ব্যাগ নিয়ে পায়ে
হেটে হেটে পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। সবাই রেডী হয়ে নিলাম।
বোট থেকে নেমেই এই ঝর্না দেখলাম |
এখানেই বোট থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো |
আমরা উচু-নিচু রাস্তায় ট্রেকিং শুরু করলাম। মাঝে ঝিরিপথ
পড়লো। সেখান থেকে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। মাথার উপর প্রচন্ড রোদ। তাই আমি মাথায় গামছা
পেচিয়ে নিলাম। অনেকে ক্যাপ পড়লো। থানচি থেকে আসার সময় একটা জিনিস নিতে ভুল হয়ে
গেছে। সেটা হলো লাঠি। পাহাড়ি পথে বাঁশের বা অন্য গাছের ডালপালার শক্ত ছোট লাঠি
খুবই দরকার। কিছুক্ষন হেটে বুঝলাম লাঠি থাকলে ভালো হত। তবে ভাগ্য ভালো যে পথের
আশেপাশে অনেক ডালপালা পড়ে ছিলো। সেগুলোই আমরা লাঠি বানিয়ে ব্যবহার করলাম।
ট্রেকিং চলছে |
বেশ কিছুক্ষন হেটে আমরা রুনাজন পাড়ায় পৌছালাম। তখন সূর্য
লাল বর্ণ ধারণ করেছে। বিকাল হয়ে গেছে। আমি মনে মনে ভয়ে আছি রাত হয়ে যাবে কিনা
ভেবে। ছোট্ট একটি আদিবাসী পাড়া এটি। আমরা এখানে আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যেতে
থাকি। আরো অনেক পথ বাকি আছে বলেই মনে হচ্ছে।
রুনাজন পাড়া |
সূর্যের আলো ফুরিয়ে যাচ্ছে আর আমরা হেটেই যচ্ছি। সবই পাহাড়ে
চলতে চলতে মানুষের সৃষ্ট পথ। অনেক জায়গায় কোন পথই নেই। বড় বড় পাথর ডিঙাতে হচ্ছে।
পায়ের নিচে মাঝে মাঝে আসছে ঝিরিপথের স্বচ্ছ পানি। সামান্য কষ্ট হলেও বেশ ভালোই
লাগছে। পথে একটি ঝিরিতে বসে আমরা বিস্কুট খেলাম, পানি পান করলাম। পাহাড়ে এই
পরিবেশে বিস্কুটের প্যাকেট ফেলতে মনে খারাপ লাগলো দেখে সেগুলো ব্যাগের ভিতরেই নিয়ে
নিলাম।
বিস্কুট ব্রেক |
ঝিরির পানিতে বিস্কুট চুবিয়ে খাই |
বার বার করে ট্যুর শুরুর আগে সবার ব্যাগ হালকা করতে বলা
হয়েছিলো। কিন্তু তারপরেও একজন খুব ভারী ব্যাগ নিয়ে এসেছে। তার জন্য পুরো টিমের গতি
কমে যাচ্ছে। এছাড়াও সবার সাথেই লাইফজ্যাকেট আছে। লাইফজ্যাকেটগুলো ব্যাগের সাথে
বেধে নেওয়া হলেও নড়াচড়ায় সেগুলো ঝামেলা মনে হচ্ছিলো। আমরা হাটছি তো হাটছিই। পথের
যেন কোন শেষ নেই। একসময় খুবই হয়রান লাগা শুরু করলো। বোতলের পানিও প্রায় শেষ। আর
মনের ভেতরে ভয় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে যায়। আপনি চোখের
পলক ফেলবেন আর খুলবেন। দেখবেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমাদের গাইড সিমিয়ান দাদা বলছে
আরেকটি পাহাড় উঠলেই আরেকটি পাড়া আছে। সেই পাড়ার পরেই থুইসাপাড়া, যেখানে আমরা
থাকবো। কিন্তু পাহাড় কতগুলো ওঠা হলো। কিন্তু সেই পাড়াও আসে না, আর থুইসাপাড়াও আসে
না।
অবশেষ আমরা একটি সুন্দর পরিষ্কার পাড়ায় এসে পৌছালাম। এই
পাড়াটির নাম হরিচন্দ্র পাড়া। আমরা সবাই খুবই টায়ার্ড হয়ে গেছি। সবার পিপাসা লেগে
গেছে। আর পায়ে ব্যাথা। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দেখে আর কেউই যেতে চাচ্ছে না। আমরা ঠিক
করলাম এই হরিচন্দ্রপাড়ায় থেকে যাবো। কিন্তু হায় ভাগ্যের কি করুণ অবস্তা! এই পাড়ায়
কেউ নেই। সবাই জুম চাষের ফসল তোলার জন্য জুম ঘরে গিয়ে থাকছে। এখানে পানির কোন
ব্যবস্থাও নেই আবার খাবার ব্যবস্থাও খুব সামান্য। হয়তো কোনমতে ভাত আর পাহাড়ি কোন
শাক দিয়ে খেতে পারবো। কিন্তু মুখ ধোয়ার জন্য পানি পাবো না। আমাদের সবাই তখন ঘামে
ভিজে গেছে আর পুরা শরীরে বালু আর মাটি। শেষে ঠিক হলো রাত হলে হউক আমরা থুইসাপাড়ায়
গিয়েই উঠবো।
হরিচন্দ্র পাড়া |
আমরা আবার হাটা শুরু করলাম। সবাই টর্চলাইট বের করে হাতে
নিলাম আর গায়ে ওডোমস মেখে নিলাম যাতে মশা ও পোকামাকড় না কামড়ায়। পাহাড়ের অন্ধকার যে
দেখেনি সে জানেনা এটা কতটা ভয়ংকর। টর্চের লাইটও যেন অন্ধকার ভেদ করতে চায়না।
চারদিকে ঝিঝি পোকা ডাকা শুরু করে দিয়েছে। তার মধ্যে চাপা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আমরা
১৩ জন হেটে। মাঝে মাঝে ঢাল বেয়ে নিচে নামতে হয় একদম পেছনদিক ভূমির সাথে মিশিয়ে। মাঝে
আবার ঝিরিপথ পড়ে। কালো কালো বিকট দেখতে সব পাথর সেখানে। সেগুলো পার হতে হয়। বড়
পাথরে পা দিলেই ঝামেলা। এগুলো খুবই পিচ্ছিল। তাই পানির ভেতরে ছোট ছোট পাথর খুজে
সেগুলোতে পা দিতে হয়। আগে এক পা হালকা করে দিয়ে দেখতে হয় পাথর ডেবে যাচ্ছে কিনা।
আমি ছিলাম সবার শেষে। পথে হাটতে হাটতে কেউ কেউ পিছিয়ে যাচ্ছিলো। তখন আমি সিমিয়ান
দাদাকে জোড়ে ডাক দিতাম। দাদা এসে পিছিয়ে পড়া জনকে ধরতো। কিছুক্ষন রেস্ট নিতো সে
তারপর আবার চলতে শুরু করতো। পথ আর শেষ হয়না। তাও ভালো ঝিরিগুলো ছিলো দেখে মাঝে
মাঝে বোতলে পানি ভরে নিতে পেরেছিলাম।
এর মধ্যে একজনের পায়ে খিল ধরলো। আমি দাদাকে ডাক দিলাম। দাদা
এসে তার পায়ে ম্যাসেজ করলো। কিছুক্ষন বসে রেস্ট নিয়ে আবার আগাতে শুরু করলাম।
বাকিদের থেকে অনেক পিছিয়ে গেছি। আমাদের মধ্যে একজন তার পায়ে জোক আবিষ্কার করলো।
রক্ত খেয়ে সেটা মোটা হয়ে গেছে। দাদাকে ডেকে জোক ছাড়ানো হলো। আমার পায়েও জোক ধরলো।
তবে রক্ত কম পড়েছিলো। এইযে জোক আবিষ্কার শুরু হলো এর আর যেন শেষ নেই। একটা সময়
দেখা গেলো সবার পা রক্তে লাল। জোক কামড় দিচ্ছে আমরা টের পাচ্ছিনা। যখন
দেখছি তখন জোক ছাড়িয়েই আবার হাটা দিচ্ছি। ভাগ্য ভালো তাও যে বৃষ্টি হচ্ছেনা। আমি
জানতাম পাহাড়ে জোক ধরবে। এর জন্য লবন নিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাগ থেকে লবন বের করার
সময়টুকুই পাচ্ছিলাম না।
দাদা আর কতদূর?
-
এইতো দাদা এই
পাহাড়টা পার হলেই।
দাদা পাহাড় তো পার হলাম আর কদ্দুর থুইসাপাড়া?
-
দাদা এইতো সামনের
ঝিরিটা পার হলেই।
কত সময় লাগবে?
-
আর মাত্র ২০মিনিট।
কিন্তু ২০ মিনিট মানে যে ২ ঘন্টা সেটা তো আর জানতাম না।
পাহাড়ি মানুষদের গতি আর আমাদের শহরের মানুষদের পায়ের গতি সমান না। তাই যে পথ যেতে
পাহাড়িদের ২০ মিনিট লাগে সেটা আমাদের যেতে ২ ঘন্টাই লাগবে।
পাহাড়, ঝিরি, বড় বড় পাথর পার হতে লাগলাম কিন্তু থুইসাপাড়া
আর আসে না। এদিকে রাত কয়টা বাজে তার হিসেবও নেই। খুব ভয়ংকর রাস্তা এসে পড়লো সামনে।
ডানদিকে খাদ। টর্চের লাইট দিতেই দেখলাম সেখানে নিচে ঝর্নার মত। কোথা থেকে যেন নিচের
কালো কালো পাথরে পানি আছড়িয়ে পড়ছে। পা স্লিপ কেটে পড়লে কিছু না কিছু একটা ভাঙবেই
শরীরের। বামপাশে ধরার কিছুই নেই চিকন কিছু ডালপালা ছাড়া। সেই ডালপালা ধরেই বামদিকে
কাত হয়ে হাটতে লাগলাম। সবাইকে বললাম ডানে যাতে না তাকায়। কিন্তু যা করতে মানা তাই
বেশি করে মানুষ। ডানে তাকিয়ে সবাই আরো ভয় পেয়ে গেলো। কোনমতে সেই পথটি পার করলাম
সবাই।
প্রত্যেকেরই একটা মেল্টিং পয়েন্ট থাকে। এই পয়েন্টের পর সে
যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাকে দিয়ে আর কিছু করানো যায়না। আমাদের শরীরের শক্তি
প্রায় শেষ। এখন যা দিয়ে চলছি তা হচ্ছে সম্পুর্ণ মনের জোড়ে। মাঝে আরেকটি ট্রেকিং
টিম এলো আমাদের পিছন থেকে। দেখে খানিকটা ভরসা পেলাম। কিন্তু তাদের স্পীড বেশি
থাকায় তারা আর আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে পাস করে চলে যায়। সাথে নিয়ে যায় আমাদের
টিমের সামনে থাকা একজনের টর্চলাইট। এছাড়াও আমাদের টিমের সামনের আরেকজন তাদের সাইড
দিতে না পেরে আগে আগে চলে যায়। পরে সে আর ফিরে আসতে পারেনি অন্ধকারে। ঐ টিমের
সাথেই সে থুইসাপাড়া চলে যায়। খুব রাগ উঠে এসব ট্রেকারদের জন্য। আপনারা ট্রেকিং করে
পাহাড় জয় করলেন ঠিকই কিন্তু মানুষের মন জয় করতে পারলেন না। কষ্ট দিয়ে চলে গেলেন।
আমি সবার পিছনেই পড়ে আছি। একসময়
আমার আর ভয়, কষ্ট বা অন্য কোন অনুভূতিই থাকেনা। মনে হলো আমার একটাই কাজ- পাহাড়ে
হেটে যাওয়া আর সেটাই আমি আজীবন ধরে করবো। সামনে কি হচ্ছে তার কোন খেয়াল ছিলোনা
আমার আর। পরে জানলাম সামনে একজন আদিবাসী এসেছে জুমঘর থেকে। সামনেই জুমঘর আছে। সেখানে
আমরা রাতে থাকতে পারবো। সে আমাদের সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি পাহাড়ি পাথুড়ে
রাস্তা শেষ হয়ে ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে হেটে যাচ্ছি। উপরে টর্চের আলো দেখা যায়।
সেখানেই জুমঘর।
আমরা জুমঘরে উঠলাম রাত ৯.৩০টায়।
কিন্তু মনে হচ্ছিলো এখন রাত ১-২টা বাজে। আসলে পাহাড়ের রাস্তার ১ কিলো মানে হলো
সোজা রাস্তার ৪ কিলো। কষ্টটা অনেক বেশি হয়েছিলো তাই। জুমঘরে উঠেও বিপদ। আমাকে
আস্তে আস্তে উঠতে বলা হলো। এটা নাকি পাহাড়ের উপরে মাঁচার মত বাঁশ দিয়ে করা। বেশি নড়লেই
ভেঙ্গে যাবে। একে তো অন্ধকার দেখা যায়না টর্চের প্রায় চার্জ শেষ হওয়া আলোতে। তার উপর বাঁশের
ঘর নাকি ভেঙ্গে পড়বে। পড়লাম মুসিবতে।
যারা জুমঘর দেখেন নাই কখনো
তাদের একটু বুঝিয়ে বলি ব্যাপারটা। পাহাড়ের মাঝে কিছু পাহাড়ে বিভিন্ন ধরনের ফসল
একসাথে চাষ করা হয়। সেগুলোকেই জুমচাষ বলে। এরকম পাহাড়ে একটি করে ঘর থাকে ফসল রাখার
জন্য। এই ঘরের সামনে বড় খোলা জায়গা থাকে। সেটার নিচে বাঁশের ফ্লোর থাকে। এটাকে
ঘরের উঠান বলা যেতে পারে। আর তার পাশে থাকে দুইটা ছাউনি দেওয়া ঘর। একটাতে চাষীরা
ঘুমায় আরেকটিতে ফসল রাখে। এরকমই একটি জুমঘরে আমরা উঠলাম।
জুমঘরে রাতে মুরগী জবাই দেওয়া
হলো আমাদের খাবারের জন্য। আমরা জুমের লাল চালের ভাত, পাহাড়ি মুরগী, শশাজাতীয় সবজীর
রান্না খেলাম। খেতে অমৃত লাগলো। তবে কোন এক অজ্ঞাত কারনে খাবার সময় সবার মুখের
উপরের তালু ব্যথা করলো। খাবার পর সবাই শুয়ে পড়লাম। ছেলেরা সবাই জুমঘরের উঠানে যে
যার ব্যাগ আর লাইফজ্যাকেট মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়লাম। আর মেয়েরা ভেতরের ঘরে শুয়ে
পড়লো।
আকাশে খানিকটা মেঘ। তারাগুলো
বেশি একটা দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি হলে খবর আছে এখন। কয়েকজন ঘুমিয়ে পড়েছে বোঝা যায়।
কিন্তু একটু পরেই আস্তে আস্তে আকাশের মেঘগুলো সরে গেলো। চারদিকে কোন আলো নেই, আজকে
চাঁদও নেই। পুরো আকাশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ তারা। এই তারা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে গেলাম
পাহাড়ের উপরের অজানা অচেনা এক আদিবাসীর জুমঘরে। এটাই আমাদের ফাইভ বিলিয়ন স্টার
হোটেল।
এই ট্যুর নিয়ে লেখা অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলোঃ
এই ট্যুর নিয়ে লেখা অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলোঃ
0 comments:
Post a Comment