পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে, স্বর্গের খোঁজ (পার্ট – ২)
জুমঘরের
সকাল (১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
ঘুম
ভেঙ্গে গেলো মুরগীর ডাকে। জুমঘরে কিছু মুরগী উঠে ডাকাডাকি শুরু করলো। এই পাহাড়ের
জুমঘর থেকে মুরগী ডাক দেয় আর সামনের পাহাড়ের জুমঘর থেকে আরো কয়েকটি মুরগী সেই
ডাকের উত্তর দেয়। মুরগীদের এই মিটিংয়ের মধ্যে আর ঘুমানো সম্ভব না। উঠে দেখলাম
মেঘের মধ্যে বসে আছি। চারপাশে মেঘ। ঠান্ডা লাগছে শরীরে।
জুমঘরে সকাল |
খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়েছিলাম সবাই রাতে |
রাতে হাতে-পায়ে ওডোমস মেখে শুয়েছিলাম। সকালে দেখলাম ঘাড়ে একটি জোক কামড় দিয়েছে। দ্রুত জোক ছাড়ালাম। কিছুটা রক্ত বের হয়েছে। সবাই উঠে গেলে আমরা ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম। এখন আবার হেটে হেটে থুইসাপাড়া যেতে হবে। জুমঘরে থাকার অভিজ্ঞতাটি খুব সুন্দর ছিলো। আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিলো জুমঘরে থাকার। সেটা আজ পূরণ হলো। পাহাড়ি মানুষেরা সত্যিই অসাধারণ। যে কোন ট্রভেলারের বিপদে তারা সাহায্য করবে। অনেক সময়েই তাদের নিজেদের খাবার থাকে না, পানি থাকে না। কিন্তু অন্যদের সাহায্য করতে তারা দেরী করে না।
নিচে থেকে তোলা জুম ঘরের ছবি |
হাটা
শুরু করলাম জুমঘর থেকে সকাল ৮.৩০টায়। তখন রোদ পড়তে শুরু করেছে। একটি পাহাড়ে উঠলাম
আর নামলাম। সামনে কিছু ঝিরি পড়লো। তেমন কঠিন কোন পথ নয়। খেয়াল করলাম কাল রাতে আমরা
খুবই সুন্দর কিছু রাস্তা আর ঝর্ণা পাড়ি দিয়েছি। কিন্তু অন্ধকারের জন্য সেগুলো
খেয়ালই করিনি। আমাদের আজ তেমন তাড়া নেই। সবাই হাটছি, কিছুক্ষন রেস্ট নিচ্ছি তারপর
আবার হাটছি। সকাল ১০টার দিকে একটি পাহাড় থেকে নিচে নেমে দেখি সেখানে একটি খাল।
খালটি পার হতে হবে। এখানে কোমড় সমান পানি কিন্তু পানির স্রোত অনেক। সিমিয়ান দাদা
খালের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় রশি বাধলো। আমরা ঢাকা থেকেই বড় রশি নিয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর একজন একজন করে রশি ধরে দাদার সাথে সেই খাল পার হলাম। দাদা সবার ব্যাগ পার করে
দিলো। খালের এপাড়ে এসে আমরা সবাই কলা আর পানি খেলাম। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে আবার
হাটতে শুরু করলাম।
আরো কিছু ঝিরিপথ ও পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে আমরা দুপুর ১২টায় থুইসাপাড়া একদম নিচে এসে পৌছালাম। সেখানে একটি ছোট ঝর্ণা রয়েছে। সামনের সবাই উপরে উঠে থুইসাপাড়া চলে গেলো। আমরা চারজন ঐ ঝর্ণায় কিছুক্ষন বসে থাকলাম, গোসল করলাম।
ট্রেকিং চলছে |
অবশেষে
পৌছালাম সেই স্বপ্নের থুইসাপাড়ায়। যেই পাড়ায় পৌছানোর জন্য এত কষ্ট। পাড়ায় যেয়ে
দেখলাম সেখানে চায়ের দোকান আছে, পানি ও খাবার সবই আছে। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে উঠে গেলাম। আর তখনই শুরু হলো পুরো শরীরে ব্যাথা। আমাদের
দুপুরের খাবার দেওয়া হলো লাল চালের ভাত, মুরগী, শশাজাতীয় সবজির রান্না আর
ডাল। সবাই পেট ভরে খেলো। কিন্তু আবারও সেই
অজ্ঞাত এক কারণে সবার মুখের উপরের তালুতে ব্যাথা শুরু হলো। ভাত খেলেই এই ব্যাথা
হয়। খাওয়া শেষে আবার চলে যায় ব্যাথা। এটা ভাতের সমস্যা নাকি পানির সমস্যা বুঝতে
পারলাম না।
থুইসাপাড়া |
কাল
রাতে আমাদের টিমের একজন আরেক টিমের সাথে থুইসাপাড়ায় এসেছিলো। তারা এখন আমিয়াখুম
গিয়েছে। তবে আজ আর আমাদের কারো যেতে ইচ্ছে হলোনা। সবাই একটু বিশ্রাম চায়। দুপুরে
খাবার পর আমরা ঘরের বারান্দায় বসে আড্ডা দিলাম। আর তখনই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। মজার
ব্যাপার হলো পাহাড়ে বোঝা যায় বৃষ্টি আসবে কিনা। সামনের পাহাড়ে বেশ কিছুক্ষন ধরে বৃষ্টি
হচ্ছে দেখা যাচ্ছিলো। একটু পরে সেই বৃষ্টিটাই আমাদের এখানে এলো। বৃষ্টিতে চা খেতে
খেতে আড্ডা দিলাম আমরা।
থুইসাপাড়ায় ঘরের বারান্দায় আড্ডা |
থুইসাপাড়ার ঘর |
বিকালে
কয়েকজন ঘুমিয়ে পড়লো। আর আমরা পাড়া ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর ছবি তুললাম। এখানে ফোনের
নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না। তবে আজব একটা পদ্ধতি আছে ফোনে যোগাযোগ করার। চায়ের দোকানের
পাশে কয়েকটি বাঁশের খুটি বিভিন্ন অ্যাঙেলে দাড়া করানো আছে। তার উপর মোবাইল রাখার
জায়গা। সেখানে মোবাইল রেখে কিছুক্ষন অপেক্ষা করলে রবির সিমে এক দাগ পর্যন্ত
নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। সেটা দিয়েই লাউডস্পিকারে কথা বলে সবাই। আমি বাসায় যোগাযোগ
করার চেষ্টা করলাম এভাবে। কিন্তু কোন নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলো না। বিষয়টা বুঝতে
আরেকটু সময় লাগবে মনে হয়।
এভাবেই মোবাইলের নেটওয়ার্ক পেতে হয় |
সন্ধ্যায়
আমিয়াখুম থেকে আমাদের টিমের আরেকজন চলে এলো। তারা প্রবল বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলো।
যেতে খুব কষ্ট হয়েছে। কালও বৃষ্টি হতে পারে। আর নাফাখুম যেতে নাকি আরো বড় বড় খাল
আছে। তাই আমরা আরো দুইজন গাইড ঠিক করলাম আমাদের ব্যাগগুলো বহন করার জন্য। সন্ধ্যায়
চা খেতে খেতে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে রাতের খাবার খেতে বসলাম। খাবার মেন্যু ছিলো লাল
চালের ভাত, ডিম, মুরগী, সবজি ও ডাল। এবারও খাবার সময় মুখে উপরের তালুতে ব্যাথা
হলো। থুইসাপাড়ায় থাকার জন্য প্রতি জনের ১৫০ টাকা করে পার-নাইট লেগেছে আর খাবার
জন্য প্রতিবেলা ১৫০ টাকা করে। খরচ খানিকটা বেশি এখানে।
সুন্দর শান্ত একটি পাড়া |
রাতের
খাবার খেয়ে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। কাল খুব ভোরে উঠে নাফাখুমের
দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে।
এই ট্যুর নিয়ে লেখা অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলোঃ
এই ট্যুর নিয়ে লেখা অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলোঃ
0 comments:
Post a Comment