পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে, স্বর্গের খোঁজ (পার্ট – ৪)
বান্দরবানে
শেষ দিন (১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
সকালে
দাদা সবাইকে ডেকে তুললো। রেমাক্রি খালের পানি নাকি অনেক বেড়ে গিয়েছে। আমাদের দ্রুত
যেতে হবে। কাল সারা রাত প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। আমরা দ্রুত ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ
গুছিয়ে বোটে উঠে পড়লাম। আগের মতই তিনটি বোট। যাত্রা শুরু করলো বোট তিনটি। আমরা সবাই
লাইফজ্যাকেট পড়ে ভালোভাবে বেধে রাখলাম শরীরের সাথে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে এখনো।
শুরু
হলো বোটে করে থানচি যাত্রা। পানির স্রোত প্রচন্ড। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সাঙ্গু নদী
দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বোট তিনটি। ইঞ্জিন চালু না করলেও পানির স্রোত বোট
অটোমেটিক টেনে নিয়ে যাবে। আমরা বড় পাথর দেখলাম। পাথরের অর্ধেক ডুবে গিয়েছে। পথে
যেতে হেডম্যান পাড়া দেখলাম পাহাড়ের উপরে। রূপকথার কাহিনীর গ্রামের মত মনে হচ্ছিলো
সেটাকে।
মেঘের রাজ্যে |
থানচি
এসে পৌছালাম সকাল ১১ টায়। এটাই সেই জায়গা যেখান থেকে ৩ দিন আগে যাত্রা শুরু
করেছিলাম। গাইডদের অফিসে ব্যাগ রেখে থানচি বাজার দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। আজকে হাট
বসেছে। পাহাড়ি ব্যবসায়ীরা নানান জিনিস সাজিয়ে বসে আছে বাজারের রাস্তায়। এক জায়গায়
দেখলাম মুন্ডি বিক্রি করছে এক বুড়ো মহিলা। আমরা মুন্ডি খেলাম। মুন্ডি হলো নুডুলসের
মত একটি আদিবাসী খাবার। এটিতে চিকন নুডুলস দেয় ও আরো কিছু নাম না জানা মসলা দেয়।
সাথে মরিচের গুড়া থাকে। এটিতে তেল হিসেবে নাপ্পি ব্যবহার করা হয়। নাপ্পি শুটকি মাছ
থেকে পাওয়া এক ধরনের সবুজ তেল। মুন্ডির টেস্ট ছিলো অসাধারণ। বান্দরবান শহরে গেলে
আমি মুন্ডি খাই। কিন্তু থানচির এই মুন্ডি আমার কাছে বেস্ট মনে হয়েছে।
থানচি বাজার |
বান্দরবানের আজিব শশা |
মুন্ডি |
আরো
কিছুক্ষন বাজারে ঘুরে আমরা অফিসে খেতে বসলাম। মাত্র ৪০ টাকায় ফ্রাইড রাইস ও চিকেন
পাওয়া যায়। ফ্রাইড রাইস খেয়ে আমরা লেমন জ্যুস নিয়ে নদীর পাশে বসলাম। সেখানে
কিছুক্ষন আড্ডা দিলাম ও ছবি তুললাম। এখানে একটি ছোট ট্যুরিস্ট স্পটের মত বানানো হচ্ছে। পাশেই
ব্রীজ। সেখানে চান্দের গাড়ি আছে। আমরা ৫০০০ টাকায় চান্দের গাড়ি ঠিক করলাম
বান্দরবান শহর পর্যন্ত। দুপুর ১২ টায় চান্দের গাড়িতে উঠে পড়লাম।
থানচিতে আমরা |
চান্দের
গাড়িতে চড়ে এবার সবেচেয় মজা পেলাম। আমরা মেঘের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। সাদা মেঘ এসে
আমাদের চোখে-মুখে লাগছে। মাঝে মাঝে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। যেতে পথে আমরা
নীলগিরিতে থামলাম। সেখানে কিছুক্ষন ঘুরে দেখলাম। তারপর আবার পাহাড়ি আকাবাকা পথে
গাড়ি চলতে শুরু করলো। বিকালে পৌছালাম স্বর্নমন্দিরে। দুইজনের পড়নে হাফপ্যান্ট
থাকায় তাদের লুঙি পড়িয়ে স্বর্নমন্দিরে ঢোকার পারমিশন দেওয়া হলো। নীলগিরিতে ঢুকতে
৫০ টাকার টিকেট ও স্বর্নমন্দিরে ঢুকতে ৩০ টাকার টিকেট কাটতে হয়। সূর্যাস্ত দেখলাম
স্বর্নমন্দিরের উপর থেকে।
নীলগিরি |
তারপর আবার চান্দের গাড়িতে উঠে পড়লাম। দ্রুত যেতে হবে
রাতের বাসের টিকেট কাটার জন্য। আসলে যেতে ইচ্ছে করছে না ঢাকায় একদমই। আমি যদি
পারতাম তাহলে আজীবন পাহাড়েই থেকে যেতাম।
স্বর্ণমন্দির |
হানিফ
বাসের টিকেট কাটলাম। রাত ৯.২০ এ গাড়ি ছাড়বে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে। নন-এসি বাস ভাড়া
৬২০ টাকাই। তবে ঢাকা-বান্দরবান রুটে আমার মতে সবচেয়ে ভালো চালায় শ্যামলী বাস আর
ইউনিক বাসের সিটগুলোতে বসে আরাম পাওয়া যায় বেশি। হানিফ যেই রুটেই চলুক না কেন তারা
জোড়ে চালায় এবং ঘুমানো যায় না বাসে।
টিকেট
কাটার ঝামেলা শেষ করে আমরা রাতের খাবার খেতে মধ্যমপাড়ায় গেলাম। আমি আগে বান্দরবান
এলেই এখানে আসতাম খাবার জন্য। মধ্যমপাড়ায় মুন্ডি পাওয়া যায় ভালো আর কিছু আদিবাসী
খাবারও রয়েছে। বাসস্ট্যান্ড থেকে এখানে আসতে টমটমে ভাড়া নিবে মাত্র ১০ থেকে ১৫
টাকা। সময় থাকলে হেটেই আসা যাওয়া করা যায়।
আমরা
টমটমে করে মধ্যমপাড়ার তোজাহ রেস্টুরেন্টে গেলাম। মেন্যু দেখেই তো সবার
চক্ষু-চড়গগাছ! এখানে আছে গুইসাপ, শুকর, ব্যাঙ, শামুকসহ আরো আজব সব খাবার। কে কোনটা
খাবে ঠিক করতে পারলো না। শেষে ঠিক হলো সব আইটেমই একটা করে নেওয়া হবে। যার যেটা
ইচ্ছা সেটা খাবে। আমি ভাত খেলাম মুরগী চাটনী, তোজাহ, বাঁশকুড়ুল আর ব্যাঙ দিয়ে। ব্যাঙের টেস্ট
অস্থির ছিলো। এটা না মাছ আবার না মুরগী। আমি এর আগে এখানে এসে গুইসাপ খেয়েছিলাম।
টেস্ট ভালো ছিলোনা তাই আর খেলাম না। তবে টেবিলে শামুকের তরকারী নেওয়াটা ঠিক হয়নি।
সেটা দেখে আমি ঘেন্নায় আর ভালো করে খেতে পারলাম না।
পাহাড়ি সবজি তোজাহ |
রাতের
খাবার খেয়ে সবাই গেলাম পাশের গলিতে মুন্ডি খেতে। একজন দিদি আমাদের মুন্ডি বানিয়ে
দিলো। এখানের মুন্ডির নুডুলসগুলো বেশি মোটা। খেতে মজা আছে কিন্তু থানচির মুন্ডি
বেশি মজা ছিলো। সেখানে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে মধ্যমপাড়া ঘুরে দেখলাম। তারপর ৯টায়
আবার বাসের কাউন্টারে চলে গেলাম।
মুন্ডি বানানো হচ্ছে |
৯.৩০ এ
হানিফ বাস এলো। বাসটি একদম নতুন ছিলো। এরকম নতুন বাসকে নাকি প্যাকেট বাস বলা হয়।
রাতে বাসে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম হলো না। রাতে বাস ব্রেক দিলে সেখানে চা
খেলাম। পেটের অবস্থা খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।
ঢাকায়
পৌছালাম (১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭)
ভোর ৬.৩০
এ বাস ঢাকায় পৌছালো। একেকজন একেক জায়গায় নেমে গেলো। আমি আর আরো তিনজন নামলাম
কলাবাগানে। বিশ্বাস হচ্ছেনা শেষ পর্যন্ত এই ট্যুর শেষ হয়েছে আর আমরা এখন ঢাকায়।
আবার সেই রুটিনমাফিক ব্যস্ত জীবনের শুরু হতে যাচ্ছে।
ধন্যবাদ আবার আসবেন |
এই
বান্দরবান ট্যুরটি সারাজীবন মনে থাকবে। আমাদের গাইড সিমিয়ান দাদা যে পরিমাণ
সাহায্য করেছে আর কষ্ট করেছে তা বলার মত নয়। দাদাকে খুব মিস করবো। পাহাড়ের সহজ-সরল
ভালো মানুষগুলোকে মিস করবো। এই ট্যুর থেকে আমি অনেক কিছু শিখলাম। তার মধ্যে এক
নাম্বার হচ্ছে টিমওয়ার্ক। টিমের সবাই অনেক হেল্পফুল ছিলো। একজনের বিপদে আরেকজন
সাহায্য করেছে, সান্তনা দিয়েছে। এছাড়াও রেসপন্সিবিলিটি নেওয়া, অনুকুল পরিবেশে
সার্ভাইভ করা শিখলাম। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো। এসময় বৃষ্টি থাকার কথা হলেও আমাদের
ট্রেকিংয়ের সময় বৃষ্টি আসেনি। সবাই যে সুস্থ্যভাবে ফিরতে পেরেছি এজন্য ধন্যবাদ
সৃষ্টিকর্তাকে। বান্দরবানে আবার যাবো আশা করি। আরো অনেক দেখা বাকি আছে।
এই ট্যুর নিয়ে লেখা অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলোঃ
এই ট্যুর নিয়ে লেখা অন্যান্য ব্লগপোস্টগুলোঃ