Saturday, May 23, 2015

ঘুরে এলাম বান্দরবন (পর্ব - ১)

সেমিস্টার ব্রেক শুরু হলো। হাতে অল্প কিছুদিন সময়। আগে থেকেই কোথাও যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। মাঝে থেকে এক বন্ধু খাগড়াছড়িতে পল্টি মারলো। বাকি সবাই মিলে চটজলদি প্ল্যান করে ফেললাম বান্দরবন যাওয়ার। আমাদের সাথে ছিলো এক চাইনিজ (চাকমা) বন্ধু হেনড্রিক্স। তার ভালো নাম শুভ চাক। সে আগেই চলে গেলো বান্দরবন। আমরা চারজন - আমি, সুফি (তাফসীর), মাঝি (প্রিতম) আর তন্ময় রওনা দিলাম ঢাকা থেকে। রাত ১০টার বাস। সবাই কলেজের বন্ধু।


১ম দিনঃ

এক বিশিষ্টজন (আমার মামা) বলেছিলেন হানিফ এবং শ্যামলী বাস পরিহার করতে। কেননা এদের ড্রাইভারগুলো নাকি অনেক রাফ চালায়। এজন্য আমরা উঠেছিলাম 'সৌদিয়া' বাসে। ঢাকা টু কক্সবাজার রুট। ভাড়া ৮০০ টাকা। সকাল ৯টার দিকে রামু বাইপাসে নামলাম আমরা। বাসে এক ফোটাও ঘুমাতে পারেনাই কেউ। ড্রাইভার ছিলো এক গাজাঁখোর। একবার সামনে যেতে যেতে দেখে কোন রাস্তা নেই, দিলো কষে হার্ড ব্রেক। আবার সকালে আরেকবার হার্ড ব্রেক। সামনে ছিলো বাছুরের দল। দুইটা বাছুর মারা গেলো।

রামুতে পৌছে' টমটম' এ করে গেলাম আমরা নাইক্ষ্যংছড়ি। রামু পড়েছে কক্সবাজার জেলায়। কিন্তু রামুর ভেতর দিয়ে যেতে হয় নাইক্ষ্যংছড়ি। যেটা আবার পড়েছে বান্দরবন জেলায়। বান্দরবনের একদম শেষ প্রান্তে। আমার চাকমা বন্ধু হেনড্রিক্স থাকে সরকারী কোয়ার্টারে। আমি আশা করেছিলাম তাদের বাড়িটি হবে ছন/হোগলাপাতা দিয়ে পাহাড়ি স্টাইলে করা বাড়ি। খানিকটা আশাহত হলাম।


নাইক্ষ্যংছড়ির এই রেস্টহাউজে আমরা ছিলাম
দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়িতে পাহাড় দেখতে বের হলাম। পাহাড়ের পাশ দিয়ে লেক বয়ে গেছে। জায়গাটা একটা পার্কের মত। ছাউনি দেওয়া ঘর আছে কয়েকটি। লেকের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। পাহাড় থেকে নামার সময় ভিডিও করছিলাম। সেসময় দৌড় দেওয়ার সময় আমার মানিব্যাগ পড়ে গেলো। পাহাড়ের নিচে নেমে সেটা মনে পড়লো। আবার উপরে উঠে তা পাওয়া গেলো।

পাহাড় ও লেকের মাঝে কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজ
দুপুরে হেনড্রিক্সের বাসায় খেলাম। অন্যরকম খানাদানা। পাহাড়ি চালের মোটা ভাত। সাথে আইটেম ছিলো লইট্টা মাছের কোপ্তা, সবজি, মুরগীর মাংস, চিংড়ি, ডাল আর নুডলস এর মত জিনিস দিয়ে রান্না করা চিকেন। জিনিসটা দেখতে নুডলসের মত। কিন্তু নুডলস নয়। এক ধরনের সবজি। এটা খুব মজা ছিলো। কিন্তু অতিরিক্ত ঝালের কারনে আমি খেতে পারিনি।

বিকালে রেস্টহাউজে গিয়ে রেস্ট নিলাম আর প্ল্যান করতে লাগলাম সবাই। এর মধ্যে আরেক চাকমা বন্ধু কাতেলা চাক (কেটি) চলে এলো। সন্ধ্যার আগ দিয়ে একটা সারপ্রাইজ পেলাম। আমাদের যে বন্ধু পল্টি মেরে খাগড়াছড়ি চলে গিয়েছিলো সে এখানে আসছে। তার নাম উল্লাস। আমি আর তন্ময় এই হারামিকে আনতে গেলাম। যাওয়ার পথে আবার কিছু ছোট ছোট পাহাড় পড়লো। পাহাড় দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নেমে গেলো। চা খেয়ে রেস্টহাউজে ফিরলাম। ততক্ষনে উল্লাস চলে এসেছে। আমরা আর আনতে যাইনাই। নিজেরা ঘুরাঘুরি করে চলে এসেছি।

নাইক্ষ্যংছড়িতে পানির অভাব। অন্য এক বাসায় গেলাম রাতে সবাই গোসল করতে। গোসল করে বাজারে গেলাম। রাতে ক্যাম্পিং করা হবে পাহাড়ের উপরে। মসলা ও মুরগী কিনতে হবে। মুরগী কেনা হলো কিন্তু চামড়া ছাড়ানোর কেউ নেই। পরে হেনড্রিক্স কোথা থেকে যেন চামড়া ছিলিয়ে আনলো। বারবিকিউ মশলা পাওয়া গেল না। তাই মাংসের মশলাই কেনা হলো। সাথে আরো আনা হলো লাকড়ি, তারজালী আর খুন্টি। সবকিছু নিয়ে রাত ১২টায় চললাম আবার সেই পাহাড়ে।


সবাই দুইটা করে লাকড়ি নিয়ে উঠতে লাগলাম পাহাড়ে। দুইজনের হাতে ছিলো টর্চ। উপরে যেয়ে ছাঊনির নিচে সবকিছু সেট করা হলো। হালকা আলো রাখা হলো। মুরগী মশলা আর লবন দিয়ে ভালো করে মাখানো হলো। আর লাকড়ি কেরোসিন দিয়ে জ্বালানো হলো। আরো আনা হলো চানাচুর, কোকাকোলা আর জুস। বারবকিউ এর টেস্ট হলো অসাধারন। সবাই বন্য প্রানীর মত মুরগী চিবিয়ে শেষ করলাম। খাওয়াদাওয়ার পর রাত তখন ২টা। চারদিকে নিঃস্তব্ধ। পাহাড়ের উপরে আমরা সাত জন। আশেপাশে আর কেউ নেই, কোন লোকালয় নেই। তক্ষক ডাকছে 'টক-ট্যাং' 'টক-ট্যাং' করে। আর আমরা আড্ডা দিচ্ছি। ৩টার দিকে সবারই মনে হলো ফিরে যাওয়া উচিত। কেননা কেমন যেন একটা ভুতুরে পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিলো। চারদিকে কোন শব্দ নেই, একটু পর পর আচমকা বাতাস। সব মিলিয়ে এমন একটা পরিবেশ যেখানে থাকলে যে কেউ ভয় পাবে। আমরা পাহাড় থেকে নিচে নামা শুরু করলাম। সামনে লাকড়ির নিভু নিভু আগুন হাতে ছিলো কেটি। আর সবার পিছে হেনড্রিক্স। তারা বলল যাওয়ার সময় যদি কিছু দেখতে পায় কখনো কেউ যেন দৌড় না দেয় এবং কিছু না বলে। যেন এক স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে রাতে রেস্টহাউজে ফিরে আর ঘুমালাম না। ভুতের গল্প শুরু করলাম। সকালের দিকে সবার শেষে আমি আর উল্লাস ঘুমিয়ে গেলাম।

২য় দিনঃ

এদিন সকালে সাড়ে ১০টার দিকে উঠে গেলাম হেনড্রিক্সের বাসায় নাস্তা করতে। নাস্তায় দেওয়া হলো এক আজব পিঠা। কলাপাতায় মোড়ানো পিঠা। ভেতরে চকলেট বারের মত ভাত। খেতে মিষ্টি, নারিকেল দেওয়া ছিলো। নাস্তা করেই আমরা রওনা দিলাম বান্দরবনের পথে বাসে করে। রামু এসে কক্সবাজার যাবার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু তাহলে বান্দরবন ঠিকমত ঘোরা হবে না ভেবে এই প্ল্যান বাদ দেওয়া হয়েছিলো।

বান্দরবন শহরে পৌছালাম দুপুর ২টার দিকে। পথে টুকিটাকি খেয়ে নিলাম। দুপুরে আর কিছু খেতে হলো না। বান্দরবনে একটা হোটেল ম্যানেজ করলো কেটি। একটা রুম নেওয়া হলো আমাদের সাত জনের জন্য। ভাড়া ১২০০ টাকা। হোটেলে ব্যাগ রেখেই সবাই দিলাম দৌড়। আমাদের চান্দের গাড়ি চলে এসেছে।

আমাদের চান্দের গাড়ি

চান্দের গাড়ি হলো একধরনের জিপ। মাহিন্দ্রা জিপ, যার পেছনটা খোলা। বসার জায়গা ও রেলিং রয়েছে। চান্দের গাড়ি অর্ধেক দিনের জন্য ভাড়া হলো ১৪০০টাকায়। আকাবাকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ছুটে চলতে লাগলো চান্দের গাড়ি। আর সাথে চলল আমাদের গান। প্রথমে গেলাম স্বর্নমন্দিরে। সেখানে আমাকে ঢুকতে দিবেনা। কেননা আমি থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে গিয়েছি। পরে প্যান্ট টাকা দিয়ে বন্ধক রেখে আরেকটা লাল টকটকে প্যান্ট পড়ে ভেতরে ঢুকলাম। স্বর্নমন্দিরে কিছু ছবি তুলে আবার চান্দের গাড়িতে রওনা দিলাম। সময় খুব কম।

এরপর আমরা গেলাম শৈলপ্রপাত। খুবই সুন্দর একটা জায়গা। ঝর্নার ধারা বইছে। যদিও পানি এখন খুব কম। শৈলপ্রপাতের নিচে একপাশে দেখলাম সুন্দরী পাহাড়ি মেয়েরা গোসল। যেন আকাশ থেকে পরীরা গোসল করতে এসেছে। পাশে ডানাগুলো রেখে দিয়েছে। আরেকপাশে দেখি একদল পাহাড়ি বিশাল একটা গুইসাপের বারবিকিউ করছে।

শৈলপ্রপাত

সন্ধ্যার সময় গেলাম নীলাচল। সেখানে বেশ কিছুক্ষন সময় কাটালাম। তারপর চান্দের গাড়ি করে শহরে এলাম। শহরের একটি লোকাল রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। তোজাহ রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের মেন্যু দেখে তো চক্ষুচরকগাছ! যাই হোক ঠিক করলাম শূকর মাংস বাদে সবই খাবো। কি আছে এই জীবনে?

বাশঁকুড়ুল খেলাম। কচি বাশেঁর ডগা দিয়ে রান্না করা তরকারী। জীবনে এই প্রথম এত মজা করে বাশঁ খেলাম। গুইসাপের মাংস খেলাম। দেখতে বাইন মাছের মত, খেতেও তেমন। বাইন মাছ আমার বিশ্রি লাগে। তাই এটাও ভালো লাগলো না। আরেকটা খাবার ছিলো নাম 'তোজাহ'। এটা এক ধরনের সবজি। বরবটি সেদ্ধ আর তার সাথে এক ধরনের বোম্বে মরিচের মত দেখতে সবজি। মরিচের সস দিয়ে খেতে হয়। মুরগীর চাটনির টেস্ট ছিলো অসাধারন। আরো ছিলো কাকড়া, বিফ ও ডাল। ভরপেট খাবার খেলাম। তবে হরিণের মাংস আর বাশেঁর ভেতর রান্না করা চিকেন খাবার ইচ্ছা ছিলো। তা পাওয়া গেল না। এখন নাকি এটার সিজন না।

রেস্টুরেন্টের মেন্যু

সেই রাতে হোটেলে এসে সারা রাত আড্ডা হলো। আগের রাতের মতই সবার শেষে আমি আর উল্লাস ঘুমালাম। কাল সকালে ওঠে নীলগিরি যাবার কথা।

৩য় দিন (শেষ দিন) :

ভেবেছিলাম আজ সকালে উঠে রওনা দিবো। কিন্তু সবার উঠতে উঠতে সাড়ে ১০টা বেজে গেলো। তার উপর আবার বৃষ্টি এলো। বৃষ্টির মাঝে চান্দের গাড়ি নিয়ে বের হওয়া বেশ রিস্ক। তাই বৃষ্টি কমে এলে আমরা বের হলাম ১১টার পরে। রওনা দিলাম নীলগিরির উদ্দেশ্যে। পথে চিপস, কোক ও বিস্কুট দিয়েই নাস্তা করে নিলাম সবাই।

পথে চিম্বুক পাহাড় পড়লো। সেখান থেকে নিচে অস্থির ভিউ দেখা যায়। সেখানে বেশ কিছু ছবি তুললাম আমরা। চিম্বুকে খিচুড়ি খেয়ে রওনা দিলাম আবার। দুপুর ৩টার দিকে নীলগিরি পৌছালাম। কাঠফাটা রোদ চারিদিকে। পানির কোন ব্যবস্থা নাই। সবার অবস্থাই খারাপ। সেখানে ছায়া খুজে অনেকক্ষন রেস্ট নিলাম, আড্ডা দিলাম সবাই। পাহাড়ের উপর থেকে দারুন দেখা যায়। নিচে সাংগু নদী আর পাশে দূরে কেওক্রাডং দেখা যায়। নীলগিরিতে রয়েছে রিসোর্ট। রিসোর্টের ভাড়া নাকি ১৭,০০০ টাকা প্রতি রাত। ইচ্ছা আছে এখানে হানিমুন করতে আসার। পাশে আছে হেলিপ্যাড। এই জায়গায় রাত কাটাতে না পারলে জীবন বৃথা।

নীলগিরি থেকে বান্দরবন শহরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ৭টা বেজে গেলো। লোকাল রেস্টুরেন্টে 'মুন্ডি' খেতে ঢুকলাম। মুন্ডি একধরনের স্যুপ-নুডলসের মত খাবার। চিকন নুডুলস দেওয়া হয় ঝোলে। পুদিনা পাতা ও অন্যান্য মশলা থাকে। ২৫টাকা করে বাটি। আমরা সবাই দুই বাটি করে খেলাম। সাথে আরো ছিলো চিকেন কাবাব।

মুন্ডি খেয়ে আবার কেটির বাসায় রাতের খাবার খেলাম। গলা পর্যন্ত খাবার খেয়ে বাসে উঠলাম রাত ৯টায়। এবার বাস ছিলো শ্যামলী পরিবহন। ভাড়া ৬৫০ টাকা করে।

পরদিন সকাল ৮টায় বাসায় পৌছলাম। আরো অনেক কাহিনীই ঘটেছে যা হয়তো বলতে ভুলে গিয়েছি কিংবা বলা যাবে না। তবে ট্যুরটিতে সময় অনেক কম ছিলো। এ কারনেই এই ব্লগ পোস্টের নামের শেষে পর্ব - ১ লিখে দিলাম। কেননা বান্দরবনের অনেক জায়গাই এখনো ঘোরা হয়নি। কেওক্রাডং, থানচি, সাঙ্গু, রুমা, নাফাকুম, আলীকদম আরো অনেক কিছু দেখা বাকি আছে। আশা করি আবার আরেকটি ট্যুর হবে আমার এই আশা পূরণ করার জন্য।


চিম্বুকে আমরা

0 comments:

Post a Comment

Hi ! I'm Raad. And this my personal blog. Welcome to my blog.